মূল পাতা আন্তর্জাতিক এশিয়া যেভাবে ৩৮ বছর ক্ষমতায় এশিয়ার সবচেয়ে দীর্ঘমেয়াদী প্রধানমন্ত্রী
রহমত নিউজ ডেস্ক 22 July, 2023 11:52 AM
কয়েক বছর আগেই ক্যাম্বোডিয়ার শাসক তার রাজনৈতিক বিরোধীদের নিশ্চিহ্ন করতে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে নির্দয় অভিযান চালিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হুন সেনের বিরোধী দলের জনপ্রিয়তা সে সময় বাড়ছিল এবং তার ক্ষমতা হুমকির মুখে পড়ছিল। তিনি তখন আদালতকে ব্যবহার করে বিরোধী দলকে ভেঙ্গে দিয়েছিলেন। বিরোধী দলের সাংসদ পদমর্যাদার নেতাদের সংসদ সদস্য পদ বাতিল করা হয়। অন্য নেতাদের গ্রেফতার করা হয়। প্রতিপক্ষকে ধ্বংস করে ছয় মাস পরে নির্বাচন দেন তিনি। ২০১৮ সালের ঐ নির্বাচনে ক্যাম্বোডিয়ার সংসদের ১২৫টি আসনের সবকটিতেই জয় পায় তার দল। পাঁচ বছর পর আবার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে ক্যাম্বোডিয়ায়। রবিবারে হতে যাওয়া এই নির্বাচনও ভোটারদের কাছে ২০১৮ সালের নির্বাচনের পুনরাবৃত্তিই মনে হচ্ছে। রাজধানী প্নম ফে’র একজন ত্রাণকর্মী ও ভোটার বলেন, এই নির্বাচন অর্থহীন, কারণ কোনো শক্তিশালী বিরোধী দলই এই নির্বাচনে নেই, এই নির্বাচনে অংশ নেয়া কোনো দলই নেই যে সংসদে গিয়ে জনগণের কথা বলবে, তাই মানুষের মধ্যে এই নির্বাচন নিয়ে কোনো আলোচনাই নেই।
বর্তমানে ৭০ বছর বয়সী হুন সেন ১৯৮৫ সাল থেকে ক্যাম্বোডিয়া শাসন করছেন। এক সময় খেমার রুজ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করলেও পরে তাদের পতনের আগে তাদের বিরুদ্ধে গিয়ে ভিয়েতনামের সাথে যোগ দিয়েছিলেন তিনি। ৩৮ বছর ধরে ক্যাম্বোডিয়ার ক্ষমতা ধরে রাখা হুন সেন নিজেকে পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সময় ধরে দায়িত্ব পালন করা প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাবি করেন। এই দীর্ঘ সময় ধরে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাকে ব্যবহার করে তিনি ক্যাম্বোডিয়ার ক্ষমতা ধরে রেখেছেন। দীর্ঘ সময় ধরে তার রাজনৈতিক বিরোধীদের কারাগারে পাঠিয়ে, নির্বাসিত করে বা তাদের সাথে আঁতাত করে ক্ষমতার শীর্ষে নিজের অবস্থান অক্ষুন্ন রেখেছেন। ক্যাম্বোডিয়ায় ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৯ পর্যন্ত খেমার রুজের শাসন চলাকালীন সময়ে ভয়াবহ সহিংসতার শিকার হয় সেখানকার মানুষ। সেসময় কাম্পুচিয়া নামে পরিচিত ঐ জনপদের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর প্রায় ২০ লাখ মানুষকে হত্যা করা হয়। ক্যাম্বোডিয়ার মোট জনগোষ্ঠীর প্রায় ২৫ ভাগ তখন মারা গিয়েছিল। নব্বইয়ের দশকে জাতিসংঘ ক্যাম্বোডিয়াকে গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সহায়তা করে। কিন্তু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন যে বর্তমানে এটি আসলে একটি একতান্ত্রিক, একদলীয় দেশে পরিণত হয়েছে। আর প্রধানমন্ত্রী হুন সেন কোনো হিসেবেই স্বৈরশাসকের চেয়ে কম না। এশিয়ার দরিদ্রতম দেশগুলোর একটি ক্যাম্বোডিয়া। জ্বালানির উচ্চমূল্য আর স্থির মজুরি এখানকার মানুষের মূল সমস্যা। এখানে দুর্নীতি প্রায় মহামারি আকারে ছড়িয়ে গেছে, জনগণের কাছে জবাবদিহিতা নেই বললেই চলে। তার ওপর জমি দখল আর অপরাধের মাত্রা বাড়তে থাকায় মানুষের জীবন আরো অসহনীয় পর্যায়ে চলে গেছে। তবে জীবন নিয়ে এত অনিশ্চয়তা থাকলেও ক্যাম্বোডিয়ার সবাই জানে যে রবিবারের ভোটে ক্যাম্বোডিয়ান পলিটিকাল পার্টি (সিপিপি) আবারো জিতবে।
হুন সেন সম্পর্কে যা জানা যায়
হুন সেনের জন্ম ১৯৫২ সালে এক কৃষক পরিবারে। নমপেন-এ বৌদ্ধ ভিক্ষুদের কাছে শিক্ষা লাভ করেন তিনি। ষাটের দশকের শেষ দিকে তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। সে সময় এক বন্দুকযুদ্ধে তিনি তার বাম চোখ হারান। সত্তরের দশকের শেষদিকে পল পটের স্বৈরতান্ত্রিক শাসনামলে হুন সেন খেমার রুজের একজন কমান্ডার ছিলেন। খেমার রুজের শাসনামলে ক্যাম্বোডিয়ায় প্রায় ২০ লাখ মানুষ মারা যায়। ১৯৭৭ সালে তিনি ভিয়েতনামে পালিয়ে যান এবং খেমার রুজের বিরোধী সেনাদের সাথে যোগ দেন। ক্যাম্বোডিয়ায় ১৯৭৯ সালে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করে ভিয়েতনাম। তখন তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দেশে ফেরত যান। পরে ১৯৮৫ সালে ৩৩ বছর বয়সে তিনি ক্যাম্বোডিয়ার প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৯৩ সালের নির্বাচনে হুন সেন হেরে গেলেও পরাজয় মানতে অস্বীকার করেন। পরে ফুচিনচেপ পার্টির প্রিন্স নরোদম রানারিধের সাথে সমঝোতা করে দ্বিতীয় প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকেন। এরপর ১৯৯৭ সালে রক্তক্ষয়ী এক অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে দেশের ক্ষমতা দখল করেন এবং প্রিন্স রানারিধকে সাময়িকভাবে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেন।
লোক দেখানো নির্বাচন
এ বছরের নির্বাচনের আগে কয়েক মাস ধরে হুন সেন তার একমাত্র কঠিন প্রতিপক্ষ ক্যান্ডললাইট পার্টিকে বিভিন্নভাবে দমন করেছেন। নির্বাচনের আগে শেষ পর্যন্ত তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। সাবেক বিরোধীদলের ধ্বংসাবশেষ থেকে গত বছরই ক্যান্ডললাইট পার্টির সূচনা হয়। গত বছরের স্থানীয় নির্বাচনে ক্ষমতায় থাকা দলের ব্যাপক ভয়ভীতি দেখানো ও ভোট জালিয়াতির প্রমাণ থাকা স্বত্ত্বেও ক্যান্ডললাইট পার্টি ২২% শতাংশ ভোট পায়। এই বিষয়টি হুন সেন মেনে নিতে পারেননি। তাই তারা বড় হুমকি হয়ে ওঠার আগেই তিনি ‘ক্যান্ডললাইটের শ্বাসরোধ’ করেন বলে মন্তব্য করেন অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরশাসক বিশেষজ্ঞ লি মরগেনবেসার। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে হুন সেনের কার্যক্রম পর্যালোচনা করছেন। ফেব্রুয়ারি মাসে ক্যান্ডললাইট পার্টির নেতাদের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নেন তিনি। পরে মে মাসে পার্টিকে নিষিদ্ধ করেন হুন সেন। পরে নির্বাচনি অফিস আইনি মারপ্যাচের ভিত্তিতে দলটিকে নির্বাচনে অংশ নিতে অবৈধ ঘোষণা করে। এ বছরের নির্বাচনে আরো ১৭টি পার্টি অংশগ্রহণ করছে। কিন্তু তারা হয় অনেক ছোট অথবা ক্ষমতাসীন দলের সাথে সম্পৃক্ত। সে কারণে এই দলগুলোকে এই নির্বাচনে একেবারেই তাৎপর্যহীন মনে করা হচ্ছে। ক্যান্ডললাইট পার্টির অনেক নেতাই এখন আটক হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতেই অনেক নেতা গ্রেফতার হয়েছেন। গত সপ্তাহে থাইল্যান্ডে জাতিসংঘের শরণার্থী কার্যালয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় ব্যাংকক থেকে গ্রেফতার করা হয় দুই নেতাকে।
গণতন্ত্রের অধঃপতন
নানা ধরণের আন্তর্জাতিক সহায়তা থাকলেও ক্যাম্বোডিয়ার নির্বাচনে সবসময়ই সহিংসতা আর অনিয়মের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু তবুও ২০১৮ সালের নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সেগুলোকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করা হত। কিন্তু ২০১৭ সালে বিরোধী জোট শক্তিশালী হতে শুরু করায় হুন সেন ক্ষমতা হারানোর শঙ্কায় কঠোর হতে শুরু করেন।। সে সময় দেশটির দুই অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ স্যাম রেইনসি আর কেম সোখার নেতৃত্বাধীন জোট ক্যাম্বোডিয়ান ন্যাশনাল রেসকিউ পার্টি (সিএনআরপি) স্থানীয় নির্বাচনে বিপুল সংখ্যায় ভোট পায়। এই জোটই ২০১৩ সালের নির্বাচনে ৪৪% ভোট পেয়েছিল। ঐ নির্বাচনের সময় ভোট গণনার রাতে এক পর্যায়ে যখন সিএনআরপি ক্ষমতাসীন দলের চেয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বলে মনে করা হচ্ছিল, তখন সরকার টেলিভিশনে ভোট গণনা সম্প্রচার করা বন্ধ করে দেয়। সেবারের নির্বাচনে হুন সেনের জয়ের বিরোধিতা করে পরের কয়েক মাস বিক্ষোভ করে বিরোধী দলগুলো। বিভিন্ন শহরের পথে পথে রাজনৈতিক র্যালিগুলোতে অংশ নিতো হাজার হাজার মানুষ। সেবার বিরোধীদের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে ঐ বিক্ষোভের অবসান ঘটান হুন সেন। সিএনআরপির নেতা মি. রেইনসি তার সাথে একটি চুক্তি করেন এবং ‘আলোচনা’র উদ্যোগ নেন। তবে শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়নি। তবে ২০১৩ সালে সমঝোতা করলেও ২০১৭ সালে যখন সিএনআরপি শক্তিশালী হতে শুরু করে, তখন আর কোনো সুযোগ নেননি হুন সেন। নিজ দলের নিয়ন্ত্রিত সংসদকে ব্যবহার করে তিনি আইনে পরিবর্তন আনেন যেন নিরাপত্তার খাতিরে যে কোনো দলকে নিষিদ্ধ করা যায়। তারপর এই নতুন ক্ষমতা ব্যবহার করে সুপ্রিম কোর্টকে প্রভাবিত করেন সিএনআরপিকে নিষিদ্ধ করতে। তারপর থেকে অন্তত ১০০ জন সিএনআরপি সদস্য মামলার শিকার হয়েছেন। দলের অনেক সিনিয়র নেতা বিদেশে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন। মার্চ মাসে সিএনআরপির আরেক শীর্ষ নেতা কেম সোখাকে ২৭ বছরের কারাদণ্ড দেয় ক্যাম্বোডিয়ার আদালত, যেই রায়কে যুক্তরাষ্ট্র ‘সাজানো ষড়যন্ত্র’ বলে অভিহিত করে। রাজনৈতিক নেতাদের পাশাপাশি হুন সেন অন্যান্য গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের ওপর চড়াও হন। দ্য ক্যাম্বোডিয়া পত্রিকা বন্ধ করা, আন্তর্জাতিক অধিকার সংস্থাগুলোকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করার মত পদক্ষেপ নেন তিনি। তার এসব পদক্ষেপের ধারাবাহিকতায় যুক্তরাষ্ট্র ২০১৯ সালে ক্যাম্বোডিয়ার সিনিয়র কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা দেয়। কিন্তু চীনের সমর্থন পাওয়া হুন সেন সেসবে বিচলিত হননি। কিছুদিন আগে দেশটির সবশেষ মুক্ত সংবাদমাধ্যম ভয়েস অব ডেমোক্র্যাসি বন্ধ করে দেন হুন সেন। এনজিওগুলোর নিবন্ধন বাতিল করারও হুমকি দেন তিনি। আর এই পুরোটা সময় ধরেই বিরোধীদের হয়রানি ও ভয়ভীতি দেখানো চালিয়ে গেছেন তিনি। বিশ্লেষকদের মতে, হুন সেনের কৌশল খুবই সাধারণ এবং সবার জানা। সহকারী অধ্যাপক মরগেনবেসার বলছিলেন, তিনি ঘুষ, অর্থ, ভালো সরকারি চাকরি ও জায়গা-জমি দেয়ার লোভ দেখিয়ে তার বিরোধীদের হাত করেন। যখন তাদের তিনি দলে টানতে পারেন না, তখন তাদের ধ্বংস করতে পদক্ষেপ নেন। মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এই সপ্তাহে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে যে হুন সেনের সরকার বিরোধীদের ওপর হয়রানি বাড়িয়েছে ও বিরোধী দলের সদস্যদের ঢালাওভাবে গ্রেফতার করছে। বিভিন্ন গ্রামে ক্ষমতাসীন দলের এজেন্টরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোট কিনছে এবং যাদের ভোট কেনা যাচ্ছে না তাদের হুমকি দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
হান সেনের পর কী হবে?
এ বছরের মে মাসে ক্যান্ডললাইট পার্টিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার পর বিরোধী দলটি কি করবে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়। দলটির কোনো কোনো নেতা সমর্থকদের বিক্ষোভ করার কথা বলেন। দেশের বাইরে থাকা স্যাম রেইনসি নির্বাচন বয়কটের ডাক দেন। তবে শেষ পর্যন্ত ক্যান্ডললাইট ঠিক করে যে টিকে থাকতে আপাতত তারা বড় ধরণের কোনো পদক্ষেপে যাবে না। বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন হুন সেনের ছেলে হুন ম্যানেট, যিনি পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করেছেন, ক্ষমতা নিলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। হান ম্যানলেট হুন সেনের তিন ছেলের মধ্যে সবচেয়ে বড়। তিনি ক্যাম্বোডিয়ার সেনাবাহিনীর প্রধান। হুন সেনের অন্য দুই ছেলেও পার্টি ও সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে রয়েছেন। হুন সেনের পর তারা যেন ক্ষমতায় আসতে পারে তা নিশ্চিত করতে তিনি নিজের ছেলেদের তৈরি করছেন বলে মন্তব্য করেন বিশ্লেষকরা। তবে হুন সেনের ছেলেদের মধ্যে কেউ ক্ষমতায় আসলে যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে, তা মনে করেন না অনেক বিশেষজ্ঞ। অস্ট্রেলিয়ার গ্রিফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বৈরশাসক বিশেষজ্ঞ লি মরগেনবেসার বলছিলেন, কোনো গাছের ফল সেই গাছ থেকে খুব একটা দূরে গিয়ে পড়ে না। পরিবারতন্ত্রের অন্যান্য উদাহরণ পর্যালোচনা করলে আমরা সেরকমই দেখতে পাই। আর হুন সেন যে কবে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াবেন, সে বিষয়েই আসলে কারো ধারণা নেই।
সূত্র : বিবিসি বাংলা